গৌরীপুর হানাদার মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর

প্রকাশিত: ৫:০৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৮, ২০২০

কমল সরকার, গৌরীপুর(ময়মনসিংহ) প্রতিনিধিঃ পাক-হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর এই দিনে ময়মনসিংহের গৌরীপুর মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পরাজিত হয়ে পাক-হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে গৌরীপুর ছেড়ে চলে গেলে শত্রুমুক্ত হয় এ উপজেলা।

এ প্রসঙ্গে গৌরীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো.আব্দুর রহিম জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর এপ্রিলের প্রথম দিকে গৌরীপুরে শুরু হয় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম পর্যায়ের লড়াই-সংগ্রাম। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও এমসিএ মরহুম হাতেম আলী ও গৌরীপুর মহাবিদ্যালয়ের মরহুম অধ্যাপক সৈয়দ আলী হাসানের তত্ত্বাবধানে ১৭টি রাইফেল দিয়ে শুরু হয় স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ। তাদেরকে সহযোগিতা করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মো. মমতাজ উদ্দিন।

পাক বাহিনীর হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ থেকে রেলপথে পাক হানাদার বাহিনী গৌরীপুরে প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুরে প্রবেশ করেই শুরু করে হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। ওই দিন সকাল থেকেই পাকিস্থানী জঙ্গি বিমান গৌরীপুরের আকাশে টহল দিতে থাকে। আকাশ থেকে যুদ্ধ বিমান রেলস্টেশন, কলেজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুর শহরে প্রবেশ করে কালীপুর মোড়ে গুলি করে হত্যা করে স্কুল শিক্ষক ব্রজেন্দ্র বিশ্বাসকে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুর দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যায়। এসময় একে একে সবাই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিব বাড়ীতে আশ্রয় নেন এবং ট্রেনিং নিতে শুরু করেন।

এদিকে গৌরীপুরে পাক হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষের উপর চালায় নির্মম অত্যাচার। ১৬ মে সকালে হানাদার বাহিনী শালীহর গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যায় বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক মধূ সূধন ধরকে এবং শহর থেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কৃষ্ণ সাহাকে। আজো তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগস্ট মাসে গৌরীপুরে অবস্থানরত পাক বাহিনীর উপর হামলা শুরু করে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় তারা হানাদারদের চলাফেরা ও যোগাযোগ ব্যর্থ করে দিতে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেন যোগাযোগের মাধ্যম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেল সেতু, অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করেন রেলস্টেশন ও পাটগুদাম।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলায় পাক বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং শালীহর গ্রামে প্রবেশ করে গণহত্যা শুরু করে। সেখানে ১৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং ধরে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবুল হাসেমের পিতা ছাবেদ হোসেনকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ৩০ নভেম্বর পলাশকান্দায় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন জসিম উদ্দিন। পাক বাহিনীর হাতে ধরা পরে সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম মনজু ও মতিউর রহমান। পরে ধৃতদেরকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বেয়নেট দিয়ে খুবলে খুবলে নির্মমভাবে হত্যা করে। শ্যামগঞ্জে শহীদ হন সুধীর বড়ুয়া।

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে গৌরীপুর শহর ছাড়া সমস্ত এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাক হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর দিনগত রাতে শহর ছেড়ে রেলযোগে গৌরীপুর থেকে পালিয়ে যায়। ওইদিন রাতেই মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী কমান্ডার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে আবুল কালাম আজাদ, আ. হেকীম, নজরুল ইসলাম, সোহরাব, ছোট ফজলু, আনসার, কনুসহ একদল মুক্তিযোদ্ধার নিকট গৌরীপুর থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে। এই খবর মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে শহরের মুক্তি পাগল জনতা জয় বাংলা ধ্বনিতে গৌরীপুরের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে এবং প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে বরন করে নেন বাংলার দুর্জয় সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে গৌরীপুরে যাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম হাতেম আলী মিয়া (এমসিএ), ডা. এম এ সোবহান, মো. খালেদুজ্জামান, নজরুল ইসলাম সরকার, সোবান আজাদ, নাজিম উদ্দিন, যুদ্ধকালীন ১১নং সাব-সেক্টর কমান্ডার মরহুম তোফাজ্জল হোসেন চন্নু ও মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মরহুম মজিবুর রহমানের নাম অন্যতম।
তিনি বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।