ভাঙ্গণের কবলে হাওর, ভিটে মাটি হারাচ্ছেন কৃষক

প্রকাশিত: ৯:১০ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক : খালিয়াজুরীর হাওর জুড়ে এখন কেবলই হাহাকার। বৈশাখের বাম্পার ফলনে রেকর্ড উৎপাদনের ধান ঘরে তোলার সুখ মিলিয়ে গেছে আষাঢ় শ্রাবণে অতি বন্যার পানি আর তীব্র ঢেউয়ের তান্ডবে। ভিটে মাটি ভেঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাওর গর্ভে। বানের জল আর তীব্র ঢেউয়ের থাবায় অসহায় হয়ে পড়েছে মানুষ।

নিচু গ্রামগুলোতে পানি উঠে পড়ায় মজুদ ধান নষ্ট হচ্ছে। গবাধি পশু ছেড়ে দিচ্ছে কম দামে। সরকারের কাছে গ্রাম রক্ষায় বেরিবাধ নির্মাণসহ ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা প্রদানের দাবি এলাকাবাসীর। বন্যার্তদের সাহায্যে ইতোমধ্যে ত্রাণ পাঠিয়েছেন ডাকা ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বন্যা কবলিত মানুষের নিয়মিত খোজ খবর রাখছেন বলেও সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার এএইচএম আরিফুল ইসলাম এলিন বলেন, প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি। শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা আছে। উপজেলার বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র গুলোও প্রস্তুত রয়েছে। সরকারি ত্রাণ সহায়তা ইতোমধ্যে পৌছে গেছে। বিতরণও শুরু হয়ে গেছে। এসময় তিনি বন্যার পানি নয়, বানের ঢেউয়ে কৃষকদের বাড়ি ঘর ভেঙ্গে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জানা যায়, নেত্রকোনা জেলার হাওর উপজেলা খালিয়াজুরী ৬টি ইউনিয়ন ও ৮৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। প্রায় ৬৩ হাজার ভোটারের এ উপজেলার জন সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার। উপজেলার ছোট বড় প্রায় ৩৫ গ্রামের ঘরে পানি প্রবেশ করেছে এবারের বন্যায়। আর ভাঙ্গণের শিকার প্রায় অর্ধশত গ্রাম। বন্যায় ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ।

দিন রাত ভাঙ্গণ রোধে চেষ্টা করে যাচ্ছেন মানুষ জন। খড় কুটা, কচুরিপানা, বাশ দিয়ে চেষ্টা করেও আটকাতে পারছেন না ভাঙ্গণ। বৈশাখে ধান পাওয়ার সুখ আর নেই তাদের। বাড়ি রক্ষায় প্রতি পরিবারের প্রায় ৩০ হতে ৪০ হাজার টাকা ব্যায় হয়ে গেছে। বানের জল হতে ভিটে রক্ষায় ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে বৈশাখী ধান বিক্রির টাকা।

উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের উত্তর পাড়ার ফারুক আহমেদ বলেন, প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা ব্যয় হলেও বাড়ি রক্ষা করা যাচ্ছে না, বিক্রি করার মতো আর ধানও নেই। তাই আল্লার কাছে প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

খোজ নিয়ে জানা যায়, মেন্দেীপুর উনিয়নের রসুলপুর সহ প্রায় ৪টি গ্রামে পানি উঠেছে, পানি উঠেছে গাজীপুর ইউনিয়নের ৫টি গ্রামেও, খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের ৬টি নিচু পাড়া ও ৪টি গ্রামে পানি উঠেছে। নগর ইউনিয়নেরও ৫টি নিচু গ্রাম তলিয়েছে বন্যার পানিতে। চাকুয়া ইনিয়নে লিপসিয়া বাজার সহ অন্তত ৪ গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৬ গ্রামের অন্তত ১৪টি পাড়ায় পানি প্রবেশ করেছে। গ্রামবাসীর অনেকেই তাদের বাড়ি ঘরে রেখে উচু গ্রাম গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ অন্য উপজেলায় আত্মীয়দের বাড়িতে চলে গেছেন।

সরে জমিনে পরিদর্শনে গেলে উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামীম মোড়লকে ইউনিয়নের শ্যামপুরে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়। আলাপ চারিতায় জানা যায়, সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি তিনি নিজ উদ্যোগে ব্যক্তিগত তহবিল হতে বন্যার্তদের মধ্যে চিরা গুড় বিতরণ করছেন। এসময় তিনি বলেন, ইউনিয়নের প্রত্যেকটি গ্রাম বাড়ি ভাঙ্গণের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে কৃষ্ণপুর হতে কল্যাণপুর পর্যান্ত ভাঙ্গণের চিত্র খুবই ভয়াবহ। তার জন্য তিনি রাস্তার পাশে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ব্লক বসানোয় অব্যস্থাপনার কথা বলেন।

পরিদর্শনে দেখা যায় উপজেলা ব্যাপী ২০০৪ সালের পরে গড়ে উঠা সকল পাড়া মহল্লা গুলোতে পানি উঠেছে। বর্ষার পানির অতিত জরিপ অনুযায়ী এসব গ্রামগুলো আরো ২-৩ হাত উচু হলে অন্তত গ্রামে পানি উঠতো না। আর ভাঙ্গণ বিবেচনায় গাজীপুর, নগর আর কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন বেশি ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে। বিশেষ করে কৃষ্ণপুরের ঈদগাহ মাঠ হতে কুতুবপুর পর্যন্ত রাস্তঘাটসহ বাড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে খুবই বেশি। বাতাসের সাথে উত্তাল ঢেউয়ে রাস্তা ভেঙ্গে বসতবাড়ি ভাঙ্গতে শুরু করেছে। এলাকাবাসী দিনরাত পরিশ্রম করেও রক্ষা করতে পারছে না তাদের ভিটেমাটি।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ডাক্তার মুজিবুর রহমান তালুকদার, কৃষ্ণপুর হতে কুতুবপুর ৩ কিলোমিটার রাস্তা ও পাশ^বর্তী বাড়িঘর ভাঙ্গার জন্য রাস্তার পাশে ব্লক বসানোর কাজ পাওয়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেন। সময় মতো শেষ করতে না পারা, দুর্বল ব্লক আর ব্লক বসানোয় অনিয়মকেও দায়ী করেন তিনি। ব্লক বসানো ঠিক মতো হলে এতো ক্ষতি হতো না বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। এ নিয়ে ঠিকাদার শহিদুলকে মুঠুফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেন নি।

খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সানোয়ারুজ্জামান যোসেফ মনে করেন, ভাঙ্গণ রোধে চাই স্থায়ী উদ্যোগ। জনপদ রক্ষায় প্রতি গ্রামে বেরিবাধ নির্মাণে সরকারের সহযোগিতা চান তিনি।

উপজেলার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীক কেন্দ্র লেপসিয়া বাজার। বাজারের কাঠমল সহ অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দৈনন্দিন লেনদেনে পড়েছে অস্বাভাবিক ভাটা। উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও চাকুয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন লেপসিয়া বাজার বন্যা কবলিত হওয়ায় পুরো উপজেলায় এর প্রভাব পড়েছে। এটি উপজেলার সবচেয়ে বড় মোকাম। তিনি ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

হারের প্রতিটি গ্রাম খুবই বিচ্ছিন্ন। বর্ষাকালে এ চিত্র আরো বাস্তব হয়ে ফুটে উঠে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় সাগরের মাঝে ভেসে থাকা কিছু জলজ উদ্ভিদ। বন্যা আর বানের সাথে যুদ্ধ করেই বছরে পর বছর টিকে আছে গ্রামগুলো। বাড়ি ভাঙ্গণ রোধ ও মেরামতে প্রতিবছরই অনেক ব্যয় হয় হাওরবাসী। বর্ষায় ভেঙ্গে যাওয়া গ্রমগুলো কার্তিক মাসে মাটি ভরাট করে পুনর্গঠন করা হয়।

ভাঙ্গণ রোধে প্রতিটা গ্রাম গ্রামরক্ষা বাধ নির্মাণ খুবই জরুরি। গ্রামরক্ষা বাধ হলে একদিকে যেমন প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি থেকে যেতে হাওর বেশি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ভাবে আরো সমৃদ্ধ হতো হওর। তাই গ্রামরক্ষা বাধ নির্মাণে আবেদন জানিয়েছেন সর্বস্থরের জনগণ।