পরিবর্তনের কারিগর হোন: কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ, মে ২৪, ২০২৩

অনলাইন ডেস্ক : কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নতুন ও ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করার মানসিকতা নিয়ে পরিবর্তনের কারিগর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত ‘বাংলাদেশ: একটি উন্নয়ন মডেল: শেখ হাসিনার কাছ থেকে শেখা’ শীর্ষক অধিবেশনে তিনি এ আহ্বান জানান।

কাতার ইকোনমিক ফোরাম-২০২৩-এ যোগদানের জন্য দোহায় তিন দিনের সরকারি সফরে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘নেতৃত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করুন এবং পরিবর্তনের কারিগর হোন।’শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করুন, আপন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মনোনিবেশ করুন এবং দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করুন।’

তিনি বলেন, ‘আপন লোকজন এবং দলের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আপনার মাতৃ চেতনাকে জাগ্রত করুন এবং নতুন ও ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করুন।’

শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ বক্তৃতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই। স্মার্ট বাংলাদেশে একটি স্মার্ট সরকার, একটি স্মার্ট অর্থনীতি, একটি স্মার্ট জনসংখ্যা, একটি স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট জনশক্তি থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা। জনগণকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা হবে যাতে তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অবদান রাখতে পারে। ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের সমাজে নারীদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।’

তিনি বলেন, ‘লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করছি। সারাদেশে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সেন্টার এবং হাই-টেক পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের সরকার একটি ন্যানো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাস করেছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত বাংলাদেশ। এটিকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা ইত্যাদি দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে কষ্টার্জিত উন্নয়ন কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটা আমাদের নারী-পুরুষের সম্মিলিত কাজ। আমি শুধুমাত্র তাদের কাঙ্খিত পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছি।’

তিনি বলেন, ‘তবে আজকের অবস্থানে পৌঁছানো সহজ যাত্রা ছিল না কারণ সারাজীবন তাকে অনেক অগ্নিপরীক্ষা ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। আমার বাবাকে তার জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে। আমরা সন্তানরা তার স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। স্বাধীনতা লাভের পর সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই দেশের প্রতিষ্ঠাতা, আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমার মা, তিন ভাই, দুই ভগ্নিপতি এবং এক চাচাসহ আমাদের পরিবারের ১৮ জন সদস্যের হত্যা করা হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল তখন মাত্র ১০ বছর। সে দিন আমি এবং আমার বোন বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছি। আমার বোন এবং আমাকে ছয় বছর ধরে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার দল আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করার পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসি। আমি আমার বাবার দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও নিরক্ষরতামুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার অঙ্গীকার নিয়ে দেশে এসেছি। ফিরে এসে খাদ্য ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছি। আমি বার বার অন্তরীণ ছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার জীবন নাশের জন্য কমপক্ষে ১৯ বার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর একটি ছিল ২০০৪ সালের অগাস্টে যখন আমাকে হত্যা করার জন্য আমার উপর এক ডজন আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আমি বেঁচে গিয়েছি, কিন্তু আমার দলের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত এবং কয়েক শতাধিক আহত হয়েছেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে তিনি শুধু তার দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।’

তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন, ‘আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ। আমার স্বপ্ন হল আমাদের ব-দ্বীপকে আবারও সমৃদ্ধির দেশে পরিণত করা।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ পরবর্তী ২১ বছর সামরিক ও আধা-সামরিক শাসনের অধীনে ছিল এবং জনগণের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আমার দল, আওয়ামী লীগ, ২১ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয় এবং আমি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলাম। পাঁচ বছরে, আমরা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলাম এবং তারপর হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং সামরিক হস্তক্ষেপের আরেকটি অন্ধকার সময় অতিক্রম করতে হয়েছিল। তাদের দল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে পুনর্নির্বাচিত হয় এবং তারপর থেকে টানা দুই মেয়াদে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত সাড়ে ১৪ বছরে আমার বাবা যা চেয়েছিলেন- ‘একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ’, তার জন্য আমরা বাংলাদেশকে প্রস্তুত করেছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১৫ সালে বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সরকার সেই অবস্থা থেকে দেশকে ২০৩১ সালের মধ্যে এটি একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে ও ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ-আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা এলডিসি অবস্থান থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থার অবসান ঘটানোকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রায় সব আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি-যার জিডিপি ৪৬০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দেড় দশকে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মহামারী আঘাত হানার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০০৫-০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, যেখানে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫ দমমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা খাদ্য নিরাপত্তা, বিনামূল্যে ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল পরিষেবা, প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও জলবায়ু অভিযোজনে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘গত এক দশকের প্রচেষ্টার পর সরকার দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে বিনামূল্যে করার পাশাপাশি দেশ এখন লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে আমরা এখন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ব্যাপারে বিশ্বের সেরা ১০টি দেশের মধ্যে আছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও সংসদ উপনেতার সবাই নারী। স্থানীয় সরকারি সংস্থাগুলোতে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষিত আসন রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তিনি আশ্রায়ণ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছেন- যার মাধ্যমে আধা-পাকা ঘর তৈরি করে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। দেশে মোট ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি। এ পর্যন্ত আমরা পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ২২৮টি পরিবারের মধ্যে ঘর নির্মাণ করে বিতরণ করেছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু তাই নয়, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ ও সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রান্তে শহরের সুবিধা পৌঁছে দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে শহরে পরিণত করা হচ্ছে।’ বাসস।