মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতায় সন্তুষ্ট নয় ভোক্তা অধিদপ্তর

প্রকাশিত: ৫:০৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : সব ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতায় ইউনিলিভার, স্কয়ার, এসিআই, কোহিনুর সহ বিভিন্ন গ্রুপ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে উৎপাদন কারখানাগুলো পরিদর্শন করবে সংস্থাটি।

বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে নিত্যব্যবহার্য পণ্য সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, লিকুইড ক্লিনারের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

মতবিনিময় সভায় গ্রুপ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ইউনিলিভারের সিএফও জাহিদ মালিথা, স্কয়ারের হেড অব অপারেশন মালিক এম সাইদ, এসিআইয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পলাশ হোসাইন, কল্লোল গ্রুপের মাহিদুল হাসান বক্তব্য রাখেন।

এছাড়াও বক্তব্য রাখেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রতিনিধি, ভোক্তাকণ্ঠের সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান।

নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজার পরিস্থিতি
কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে বাজারেও সব ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

সুগন্ধি ব্র্যান্ডের সাবান
গত জানুয়ারি মাসে ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সুগন্ধি ব্র্যান্ডের সাবানের দাম ছিল ৪০ টাকা। এরপর কয়েক দফায় এ দাম বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকায়। সেই হিসাবে আট মাসের ব্যবধানে ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সুগন্ধি সাবানের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। তবে ওজনভেদে বাজারে সুগন্ধি সাবানের দাম ভিন্ন ভিন্ন।

গুঁড়া সাবান বা ডিটারজেন্ট
এ বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে ৫০০ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট গুঁড়া সাবানের দাম ছিল ৬০ টাকা। দফায় দফায় দাম বেড়ে বাজারে এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। সেই হিসাবে আট মাসের ব্যবধানে ৫০০ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট গুঁড়া সাবানের দাম বেড়ে দেড় গুণ হয়ে গেছে।

টুথপেস্ট ও শ্যাম্পু
১০০ গ্রামের একেকটি টিউবের টুথপেস্টের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। গত এপ্রিল, মে মাসেও ১০০ গ্রাম ওজনের একেকটি টিউবের টুথপেস্টের দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা। সেই হিসাবে কয়েক মাসের ব্যবধানে টুথপেস্টের দাম বেড়েছে ২১ থেকে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত। আর শ্যাম্পুর মাঝারি আকারের বোতলের দাম বেড়েছে ২০ টাকার মতো।

যা বলছে উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো
ডলার ও কাঁচামালের দামসহ উৎপাদন খরচ যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় রেখে যে পরিমাণ দাম বৃদ্ধি করার কথা সে পরিমাণ দাম বাড়াতে পারছেন না।

ইউনিলিভারের বক্তব্য
ইউনিলিভারের সিএফও জাহিদ মালিথা বলেন, আমাদের উৎপাদনের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে এবং ডলারের দাম বাড়লে আমাদের বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। ২০২০ সালে আমাদের ৫০০ গ্রামের ওয়াশিং পাউডারের দাম ছিল ৬০ টাকা এখন ৯০ টাকা। তাহলে বলতেই পারেন ৫০ শতাংশ দাম বেড়েছে। কিন্তু কাঁচামাল এবং আমাদের সব খরচের হিসেব অনুযায়ী এসব পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। কিন্তু ভোক্তাদের কথা চিন্তা করে আমরা ততটা দাম বৃদ্ধি করিনি।

স্কয়ারের বক্তব্য
স্কয়ারের হেড অব অপারেশন মালিক এম সাইদ বলেন, সাবানের মূল্য কতটা বেড়েছে, এটা আমরা সবাই জানি। তবে এই দাম হঠাৎ করে একদিনে বাড়েনি। ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কাঁচামালের পণ্য যেভাবে বেড়েছে সাবানের মূল্যও আমাদের সেভাবে বাড়াতে হয়েছে। অনেকেই মনে করছে ২০/৩০ দিন পর পর পণ্যের দাম বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা তো এসব পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করি দু’মাস পর পর। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদেরও দাম বাড়াতে হয়। সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে এমনটি করা হয়।

ক্যাবের বক্তব্য
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রতিনিধি কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, ব্র্যান্ড-ভ্যালু আর মানুষের ইমোশনকে পুঁজি করে বড় কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারির সময় এসেছে। যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি সেসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু যেসব পণ্যের চাহিদা কম সেগুলোর কাঁচামালের দাম বাড়লেও বাজারে দাম বৃদ্ধি করেনি। পণ্যের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। উৎপাদন বা পরিবহন খরচ যতটা বেড়েছে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি বাড়ানো হচ্ছে পণ্যের দাম।

যা বললেন ভোক্তার ডিজি
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে হলে তার পক্ষে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে কোম্পানিগুলোকে। সেজন্য তাদের ফ্যাক্টরিতে আমরা যাবো। কত দামে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, কোন পণ্য উৎপাদনে কত খরচ হচ্ছে এবং কোন পণ্য কী দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করতে চাই।

তিনি বলেন, পরবর্তীসময়ে আমরা পর্যবেক্ষণ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেবো। এরপর বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।

সফিকুজ্জামান আরও বলেন, এখন বাড়তি দাম দিয়ে নিত্যব্যবহার্য পণ্য কিনতে ভোক্তাদের কষ্ট হচ্ছে। বিশেষত সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট বেশি হচ্ছে। সে কারণেই আমরা মতবিনিময় সভায় বসেছি। পণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, সেটা আমরা দেখতে চাই।

তিনি বলেন, বিভিন্ন কোম্পানি ও ভোক্তাদের মধ্যে দরদাম নিয়ে একটা দুরত্ব আছে। যখন কোনো জিনিসের দাম বাড়ে। আমরা তখন ভোক্তাদের সাথে কথা বললে তারা বলেন যে তাদের পকেট কাটা হচ্ছে। আবার আমরা যখন কোম্পানিগুলোর সাথে কথা বলি তখন তারাও স্ট্রং যুক্তি দেখায়। এখন দাম বাড়ানোর বিষয়ে কোম্পানি ভোক্তাদের মাঝে তাদের দাম বাড়ানোর বিষয়টা পরিষ্কার করতে পারছে না। এই বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার দরকার।

এক প্রশ্নের জবাবে সফিকুজ্জামান বলেন, দাম নির্ধারণ করার অথোরিটি আমাদের নাই। দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সরকার যদি কোনো জিনিসের দাম নির্ধারণ করে দেয় সেটা তদারকি করার দায়িত্ব আমাদের। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে কি না, পণ্যের গায়ের রেট অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে কি না সেটা দেখা আমাদের দায়িত্ব। আমরা আরেকটা বিষয় দেখাশোনা করি সেটা হচ্ছে কোনো নকল প্রোডাক্ট বাজারে বিক্রি হচ্ছে কি না। এসব বিষয়ে আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি।

আমরা নকল পণ্য ধরতে খুব সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ভোক্তা অধিদপ্তর জানিয়ে কোম্পানিগুলোর উদ্যেশ্যে মহাপরিচালক বলেন, আপনারা আমাদেরকে জানান কোথায় এসব নকল পণ্য তৈরি হচ্ছে। কিভাবে মার্কেট চেইনে আসছে। এগুলা তো ছোট কোনো জিনিস না যে পকেটে করে নিয়ে গোপনে বিক্রি করবে। এগুলো তো ওপেন বিক্রি হচ্ছে। আপনারা আমাদের এসবের উৎসের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

এ সময় ভোক্তা অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস, আফরোজা রহমান উপস্থিত ছিলেন।