করোনায় পরিকল্পনাহীন শিক্ষা

প্রকাশিত: ১০:৩৮ অপরাহ্ণ, মে ২৭, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক ; দেশে সব কিছু খুলে গেলেও এখন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ পর্যন্ত ১৭ বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত খোলা হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী এবার ১২ জুন পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৫ মাস ধরে এই বন্ধে এখন শিক্ষার্থীরা সীমিতভাবে অনলাইন ক্লাশে অংশ নিচ্ছেন। বার্ষিক সমাপনী পরীক্ষা হয়নি। সীমিত সিলেবাসে এসাইনমেন্ট ভিত্তিক মূল্যায়ন হয়েছে। আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পেয়েছেন অটোপাস। তবে এবার অটোপাস না দিয়ে সীমিত সিলেবাসে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও পরীক্ষা নিতে পারছে না। ভর্তি পরীক্ষাও নেয়া সম্ভব হয়নি।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি বুধবার এক ভাচুয়াল প্রেস ব্রিফিং-এ বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মত দিলেই খোলার ব্যবস্থা করা হবে।

গত ডিসেম্বরে জার্মানির ইউনিসেফের প্রেস অফিসার ক্রিস্টিনে কাহমান এক সাক্ষাৎকারে স্কুল খোলা রাখার কথা জানিয়ে বলেন, জোর করে স্কুল বন্ধ রাখার কারণে বিশ্ব শিক্ষা সংকটের কবলে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী স্কুল বন্ধ করার ফলে শিক্ষা সংকট ছাড়াও আগামী কয়েক দশক ধরে বহু দেশের সমাজে এর প্রতিফলন থাকতে পারে। যার পরিণতিতে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে শিশুরা, বিশেষ করে প্রান্তিক শিশুরা।’

ইউনিসেফ-এর গত মার্চের জরিপ বলছে, বিশ্বের যে ১৪টি দেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় বছরেও শিশুরা স্কুলে যেতে পারবে না বা সীমিতভাবে লেখা পড়া করবে এটা গ্রহণ করা যায় না। স্কুল খোলাকে এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এরজন্য পরিকল্পনা করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।’

বাংলাদেশে শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের কথায়ও একই ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন,”বার বার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণাটিই নেতিবাচক। আমরা শুনতে চাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে এবং কীভাবে খোলা হচ্ছে সেই কথা।’
তার মতে, শিক্ষা নিয়ে করোনার এই দীর্ঘ সময়ে কোনো সঠিক পরিকল্পনাই করা হয়নি। আমরা বলেছিলাম যেভাবেই শিক্ষা চালু রাখা হোক না কেন শিক্ষার্থীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখে করা হবে। টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানের কোনো উন্নতি হয়নি। অনলাইন গতানুগতিক। আর অটোপাস দেয়া হচেছ। ফলে এই শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। আমরা যদি শুরু থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিকল্পনা করতাম তাহলে হয়তো এখন স্কুল খোলা যেত। অটোপাস দিতে হত না। সব খাতে প্রণোদনা দেয়া হল। এই খাতে নাই।

তিনি বলেন, ‘শিশুরা স্কুলে না যাওয়ায় এখন প্রতিদিন অভিভাবকদের তিন কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। চার কোটি স্কুলগামী শিশুর জন্য ১২ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচেছ। এটা নিয়েও কোনো পরিকল্পনা হয়নি।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানের সাথে কোনা আপোস করা যাবে না। সেটা করা হলে এই করোনায় তারা যতটা পিছিয়ে পড়বে তা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। আর ইন্টারনেট ও ডিভাইস সবার হাতে না থাকায় অনলাইন শিক্ষায় সবাই অংশ নিতে পারছে না। গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থী এবং কম আয়ের পরিবারের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও একই অবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুজিবর রহমান বলেন, ‘আমরা ছোট ছোট পাইলট প্রকল্প করে দেখতে পারতাম স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা যায় কি না।

শহরে একটু সমস্যা হলেও গ্রামে কিন্তু পরীক্ষা নেয়া যেত। শহরেও একটু পরিকল্পনা করে পরীক্ষা নেয়া অসম্ভব ছিল না। করোনা যদি বিদায় না নেয় তাহলে আমাদের প্রস্তুতি কী?’

শিশুদের এখন যে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে তাতে চাইল্ড সাইকোলিস্ট-এর পাঠ থাকা খুবই জরুরি মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক সমস্যা চার থেকে আট গুণ বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিশুদের জন্য সারা বিশ্বে এখন ব্যাক টু স্কুল প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের সেই উদ্যোগ নেয়া উচিত।’

তার মতে এই শিশুদের যদি প্রস্তুত করা যায় তাহলে নিও নরমাল বিশ্বে তারাই নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু আমাদের সেই পরিকল্পনা নেই। তাই শিক্ষার্থীরা উল্টো ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সূত্র: ডয়েচে ভেলে।