নিখোঁজের ৭ বছর পর মামলা, দালাল আটক

প্রকাশিত: ১২:১৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক : দালালের খপ্পরে পড়ে দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন যশোরের চৌঁগাছার একই পরিবারের চারজনসহ মোট ৭ ব্যক্তি। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে তারা আর ফিরে আসেননি।

ঘটনার প্রায় সাত বছর পর রোববার রাতে এক দালালকে চৌগাছা শহর থেকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারের অন্য সদস্যরা। পরে এ ঘটনায় রোববার রাতেই নিখোঁজ অমিত হাসান মুকুলের বাবা আতিয়ার রহমান চৌগাছা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ৭ ধারায় একটি মামলা করেছেন।

এ মামলায় পরিবারের লোকদের হাতে আটক দালাল ফজলুর রহমান রাজু (৪৮) কে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। সোমবার দুপুরে তাকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। মামলায় টেকনাফের দালাল রাশেদুল ইসলাম এবং অজ্ঞাত দালাল আলমকে আসামি করা হয়।

মামলা সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পাতিবিলা ইউনিয়নের মুক্তদাহ গ্রামের একই পরিবারের আতিয়ার রহমানের ছেলে অমিত হাসান মুকুল (৩০), হায়দার আলীর ছেলে আজিজুর রহমান (৪০), মৃত বদর উদ্দিনের ছেলে ফুলজার হোসেন (৪৬), মৃত ছবেদ আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম খোকন (৪০)। একই গ্রামের মৃত আত্তাপ হোসেনের ছেলে শফিকুল ইসলাম (২৭), রোস্তমপুর গ্রামের মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে রমজান আলী (৪৫) ও ফুলসারা ইউনিয়নের দুর্গাবরকাটি গ্রামের উমসান আলীর ছেলে লিটন হোসেন (২৭) ২০১৩ সালের ১ জুন মালায়েশিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই তারা নিখোঁজ রয়েছে।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা না ফেরায় নিখোঁজদের সাত পরিবারে নেমে এসেছে চরম হতাশা। উৎসব-পার্বন এলেই কান্নার রোল পড়ে যায় বাড়িগুলোতে। দীর্ঘদিন বাড়ির অভিভাবকরা নিখোঁজ থাকায় চরম দারিদ্রতা গ্রাস করেছে পরিবারগুলোকে। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। একপর্যায়ে নিখোঁজ ফুলজার হোসেনে স্ত্রী রূপবান ,শরিফুলের স্ত্রী রেশমা বেগম স্থানীয় ডিভাইন গার্মেন্টসে কাজ নিতে বাধ্য হন।

অল্প টাকায় (সে সময়ে জন প্রতি ৩ লক্ষ টাকায়) মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রলোভনে দরিদ্র পরিবারের এসব ব্যক্তিরা আদম ব্যাপারীর খপ্পড়ে পড়েন। মুক্তদাহ গ্রামে বিবাহ সূত্রে বসবাসকারী সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের গোয়ালপোতা গ্রামের ফজলুর রহমান রাজু তাদেরকে ফুসলিয়ে নৌপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠানোর পর থেকে আজও তারা নিখোঁজ রয়েছেন।

২০১৩ সালের ১ জুন বাড়ি থেকে একযোগে বের হন তারা। ১২ জুন অমিত হাসান মুকুল বাড়িতে ফোন করে বলেন, ‘আমরা সবাই নৌপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছি। ট্রলারে উঠেছি, এখনই রওনা দেব।’ ওই কথাই ছিল পরিবারের সঙ্গে তার শেষ কথা।

মুকুলের স্ত্রী চামেলী খাতুন বলেন, ‘যে নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছিল সেই নাম্বার বন্ধ পেয়েছি। বার বার চেষ্টা করেও ফোনে কাউকে পাওয়া যায়নি। এরপর ছয়টি বছর কেটে গেলেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। অতিকষ্টে দিন কাটছে আমাদের।’

নিখোঁজ শরিফুল ইসলাম খোকনের স্ত্রী রেশমা বেগম, ফুলজার রহমানের স্ত্রী রূপবান বেগম ও আজিজুর রহমানের মা মনোয়ারা বেগম (৬০) হতাশ কণ্ঠে বলেন, অনেক চেষ্টা করেও তাদের খোঁজ পাইনি। এদের মধ্যে নিখোঁজ আজিজুর রহমানের স্ত্রী দুটি সন্তান ফেলে অন্যত্র চলে গেছেন। দাদীর কাছে থেকেই তারা অতিকষ্টে জীবন পার করছে। ওদের বাবা আদৌঁ বেঁচে আছে না-কি মারা গেছে তাও জানেন না অবুঝ এই শিশুরা।

নিখোঁজের তিন মাস পর তারা মুক্তদাহ গ্রামের ঘরজামাই আদম ব্যাপারী রাজুর কাছে যান। স্বজনদের ফেরত পেতে চাপ দিতে থাকেন। এ সময় রাজু তার সহযোগী চট্টগ্রামের টেকনাফের অপর আদম ব্যাপারী রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেন।

টেকনাফের দালাল রাশিদুল তাদেরকে বলেন, ‘কোন সমস্যা নেই, তারা দুই-এক দিনের মধ্যেই মালয়েশিয়ায় পৌঁছে যাবেন।’ কিছু দিন পরই দালাল রাজু তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে রাতের আঁধারে আত্মগোপনে চলে যান। পরে টেকনাফ ও মুক্তদাহ গ্রামের দালালের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এরপর রাজু একই উপজেলার মাধবপুর গ্রামের আতিয়ার রহমানের মেয়ে রনি বেগমকে বিয়ে করে। সেখানে যাতায়াত করলেও নিখোঁজদের পরিবারগুলো তা জানতো না। দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর পর রোববার রাতে রাজুকে চৌগাছা বাজারে দেখতে পেয়ে ওই পরিবারের সদস্যরা তাকে ধরে মুক্তদাহ গ্রামে নিয়ে যায়। পরে তাকে চৌগাছা থানায় সোপর্দ করে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

নিখোঁজ মুকুলের পিতা আতিয়ার বলেন, ঘটনার প্রথম দিকে সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজ করেছি। কিন্তু আদম ব্যাপারীদের কোন সন্ধান পাইনি। আমার ছেলেসহ চৌগাছার ৭ জন ছাড়াও ঝিকরগাছা উপজেলার আরও আটজন এই দালালদের খপ্পরে পড়ে পানিপথে মালায়েশিয়ায় রওনা দেয়। প্রায় সাত বছর পার হতে চললেও কারও কোন সন্ধান পাইনি। অবশেষে রোববার সন্ধ্যায় দালাল রাজুকে চৌগাছা বাজারে দেখতে পেয়ে কৌশলে আমাদের গ্রামে নিয়ে যাই। অন্যকে জিজ্ঞাসাবাদেও সে কোন জবাব দেয়নি। অবশেষে আমরা তাকে পুলিশে দিয়েছি এবং মামলা করেছি।

চৌগাছা থানার ওসি রিফাত খান রাজীব জানান, আটক দালাল রাজুকে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলায় আদালতে পাঠানো হয়েছে।