বাংলাদেশে কেমন নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র, জানালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১২:৩৮ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০২৩

অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি যেন একটি ‘মডেল’ নির্বাচন হয় তা কামনা করেছে দেশটি। বাংলাদেশের তরফে এ ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বলেছে-অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।

সোমবার ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ঢাকার তরফে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন।

এতে তারা অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব জোরদার ও বহুমুখীকরণ, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান, জলবায়ু পরিবর্তন, শ্রম অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা এবং নির্বাচনসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বৈঠককালে স্বাধীনতা দিবসে উষ্ণ বার্তার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বাইডেনকে শেখ হাসিনার চিঠি হস্তান্তর করেছেন। এছাড়াও, ব্লিংকেনকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ড. মোমেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রিন্সিপাল ডেপুটি স্পোকসপারসন ভিডেন্ট প্যাটেল বলেছেন, বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটির বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অ্যান্টনি ব্লিংকেন।

বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা মডেল নির্বাচন করতে বলেছেন। আমরা বলেছি, আমরা মডেল নির্বাচন করতে চাই। আমাদের রক্তে গণতন্ত্র। আমাদের দেশের ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন গণতন্ত্র ও মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।’ তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কী ধরনের সহায়তা কামনা করা হয়েছে তার বিস্তারিত উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনে মার্কিন পর্যবেক্ষক কামনা করা হয়েছে। তারা যত খুশি পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারেন।’ তবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দলীয় লোকদের পর্যবেক্ষক পাঠানোর ব্যাপারে আপত্তি জানান মোমেন।

তিনি বলেন, ‘তারা সুশাসন চায়। আইনের শাসন চায়। আমরাও বলেছি, তোমাদের দেশে খুনি (বঙ্গবন্ধুর খুনি) থাকুক এটা আমাদের দেশের নাগরিকরা পছন্দ করে না। তুমি খুনিকে ফিরিয়ে দাও।’

র‌্যাবসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি, হত্যা, নির্যাতন, সন্ত্রাস এসব বন্ধ হয়ে গেছে র‌্যাবের কারণে। আমরা অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক চেয়েছি। তারা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশংসা করেছেন। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা করে আশ্রয় দেওয়ায় তারা খুব প্রশংসা করেছেন।

তারা বলেছেন, বাংলাদেশ অভাবনীয় কাজ করছে। তবে তারা বলেছে, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমরা বলেছি, কিছু দিয়েছি। কিছু চাকরি দিতে বলেছে। আমরা বলেছি, আমাদের দেশে প্রতিবছর নতুন ২০ লাখ লোক কর্মসংস্থানের জন্য আসে। আমরা সবাইকে চাকরি দিতে পারি না।

পাঁচ লাখ বিদেশে গিয়ে চাকরি করেন। বরং আপনারা কিছু আশ্রয় দেন। আমরা ভাসানচরে সাড়ে তিনশ মিলিয়ন খরচ করে রোহিঙ্গাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছি। আপনারা দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেন। আমরা স্বাগত জানাব।’

ড. মোমেন বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য করিনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আমাদের দেশে ১ হাজার ২৫১টা দৈনিক পত্রিকা বের হয়। আমাদের দেশে ৪৩টা বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এসেছে।

তারা খুবই হাইপার অ্যাকটিভ। আমাদের দেশে বিরোধী দল যখন-তখন বিক্ষোভ করছে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আমরা খুবই সতর্ক। কেউ রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস করলে আমরা শাস্তি দেব। সরকার হিসাবে এ দায়িত্ব পালন করা আমাদের বাধ্যবাধকতা।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘উনারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছেন। আমি বলেছি, অবশ্যই, আমরাও চাই। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। এটা করার জন্যে আমরা ফটো আইডি কার্ড করেছি। এতে করে ফেক ভোট হবে না। আমরা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স করেছি। আমরা একটা স্বাধীন নির্বাচন কমিশন করেছি। তাদের বাজেটও স্বাধীন।

নির্বাচনের সময় তাদের ক্ষমতা সর্বোচ্চ। তারা ইচ্ছা করলে যে কাউকে বদলি করতে পারে। নিরাপত্তা বাহিনীসহ যে কাউকে সাসপেন্ড করতে পারে। এটা তারা করেছেও। গত ১৪ বছরে কয়েক হাজার নির্বাচন হয়েছে। যেখানেই অনিয়ম হয়েছে সেখানে তারা ব্যবস্থা নিয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সরকারের সঙ্গে সব বিরোধী দলকে এগিয়ে আসতে হবে।

তাদেরকেও অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করতে হবে। আমরা চাই না নির্বাচনে কোনো লোক মারা যাক। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সব ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মানুষের খুব কষ্ট হচ্ছে। এটা ব্লিংকেনকে বলে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেছি। এটা বন্ধ করার জন্য আমাদের কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে আমরা করব।

আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে যুদ্ধের কারণে। আমরা প্রায় ১৫ মিলিয়ন লোককে সস্তায় খাবার দেই। প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মানুষকে বিনা পয়সায় খাবার দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, আগামীতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা আবার ক্ষমতায় যাব। এজন্য এ ধরনের নির্বাচনকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা তাকে বলেছি, আসেন। বাংলাদেশে দেখতে আসেন।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন আরও বলেন, ‘ধর্মীয় সহাবস্থানের ব্যাপারে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সেটা আহমদিয়া কিংবা হিন্দু সম্প্রদায় হোক, আমরা তাদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিয়ে থাকি। আমাদের এখানে কিছু লোক আছে ধর্মীয় স্বাধীনতা চায় না। আমার সরকার এটা নিশ্চিত করতে এক পায়ে দাঁড়ানো।’

তিনি বলেন, ‘আইপি প্রটেকশনের কথা তারা বলেছে। আমরা বলেছি, আমরা এখনো এলডিসি। আমরা এখনো উন্নত কিংবা শিল্পোন্নত দেশ নই। আমরা ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হব। ফলে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত পাব।’

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা বলেছি, আমাদের অগ্রাধিকার হলো তাদের দেশে ফেরত পাঠানো। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ক্ষেত্রে প্রত্যাবাসনই আমাদের অগ্রাধিকার। তারা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি সুবিধার নয়। আমরা বলেছি, ওরা গেলে সুবিধা হয়ে যাবে। ওখানে মিয়ানমার সরকারের ক্ষমতা অনেক কম। তোমরা সেখানে সেফ প্রটেকশন জোন কর। কসভোতে যেভাবে করেছ। তারা কিছু লোক নেবে। তবে কত লোক সেটা জানি না।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটা ইস্যু তুলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অনেক তহবিল আছে। কিন্তু আমরা পাই না। এটা চিন্তা করে দেখতে বলেছি। তারা বলে, এসব তহবিলের জন্য শ্রম ইস্যু আছে। আমরা বলেছি, শ্রমমানের ব্যাপারে দুটা কমিটি কাজ করছে। এই দুটি কমিটি হলো, ইউএস-বাংলাদেশ উচ্চপর্যায়ের কমিটি এবং আরেকটা হলো, কারিগরি কমিটি। এগুলো কাজ করছে। শ্রমমানের অনেক উন্নয়ন করেছি। আমরা এখন সবচেয়ে ইকো-ফ্রেন্ডলি কান্ট্রি। পৃথিবীর দশটা ইকো-ফ্রেন্ডলি গার্মেন্টের মধ্যে আমাদের দেশেই আটটা অবস্থিত।’

মিডিয়ার উপস্থিতিতে তাদের প্রাথমিক বক্তব্যে উভয় নেতা বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বিগত ৫০ বছরের দৃঢ় সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আগামী ৫০ বছরের জন্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ককে বিস্তৃত, গতিশীল ও বহুমুখী উল্লেখ করে ড. মোমেন এই সম্পর্ককে আরও উন্নত, বর্ধিত ও সুদৃঢ় করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি ‘জয় বাংলা’ দিয়ে শেষ হওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রপতি বাইডেনের প্রেরিত বার্তার জন্য ধন্যবাদ জানান।

বাংলাদেশে শ্রম খাত সংস্কারের চলমান এবং সম্পন্ন হয়েছে এমন কাজ সম্পর্কে মি. ব্লিংকেনকে অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দুদেশের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টাগুলোকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে। মি. ব্লিংকেন বাংলাদেশে শ্রম পরিস্থিতির উন্নতির জন্য দুদেশের মধ্যে চলমান যৌথ কর্মকাণ্ডের অগ্রগতির সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশের উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থার সদ্ব্যবহার করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার আহ্বান জানান।

ড. মোমেন মার্কিন সরকারকে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় উদার সহায়তা এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। ব্লিঙ্কেন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উদারভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদানের জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা আব্যাহত রাখার আশ্বাস প্রদান করেন।

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্বের ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঐকমত্য প্রকাশ করেন এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুত পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে হস্তান্তরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পুনরায় অনুরোধ জানান।

বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান, দূতালয় উপ-প্রধান ফেরদৌসী শাহরিয়ার, মহাপরিচালক (উত্তর আমেরিকা) খন্দকার মাসুদুল আলম এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাউন্সেলর ডেরেক শোলে, জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট জুলিয়েটা ভালোস নয়েস, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং শ্রম বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট কারা ম্যাকডোনাল্ড, দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট আফরিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।