কলাগাছের আঁশ থেকে শাড়ি তৈরি

প্রকাশিত: ৩:০৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৫, ২০২৩

অনলাইন ডেস্ক : মনিপুরি জনগোষ্ঠীর এলাকা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ। এখানে থেকে তাঁতের শাড়ি, গামছা, ওড়না, মাফলার, ত্রীপিচ, উত্তরীয়, ফানেক সহ বিভিন্ন তাঁতবস্ত্র তৈরী করে সারা বাংলাদেশে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসার জন্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করে থাকেন এ তাতেঁবস্ত্রগুলো। ১৯৭৫ সাল থেকে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরি করছেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁও এর মণিপুরী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী (৬৬)।

এলাকায় তাতী দেবী ওস্তাদ হিসেবে সবাই চিনে। দীর্ঘ ১৫ দিনের চেষ্টার পর দেশে প্রথমবারের মতো কলাগাছের আঁশ থেকে তৈরি সুতা দিয়ে শাড়ি বুনন হয়েছে। ১২ হাত লম্বা একটি শাড়ি বুনন করে বাংলাদেশ তথা বিশ্বকে চমকে দিলেন তিনি। দৃষ্টিনন্দন সেই শাড়ির নাম দেয়া হয়েছে ‘কলাবতী’। তবে সচেতন মহল মনে করছেন নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে কলাগাছের তন্তু থেকে হস্তশিল্প তৈরি প্রকল্পের অধীনে এই শাড়ি তৈরি হলো। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশের হস্তশিল্প ও বস্ত্রশিল্প আরও একধাপ এগিয়ে গেল। এখন প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এগুলো বাজারজাতকরণ ও সম্প্রসারণ। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুবিল মাঝেরগাঁও গেলে এ উদ্বাবনের গল্প শুনে এলেন সালাহ্উদ্দিন শুভ। মনের জোরে রাধাবতী দেবীর কলাগাছের সুতায় শাড়ি তৈরি করলেন বলে জানান।

জেলা শহর থেকে কমলগঞ্জ উপজেলা সদর প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূর। সেখান থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে মণিপুরি জনগোষ্ঠীর গ্রাম ভানুবিল মাঝেরগাঁও। পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরি করছেন। মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জে তিনিই প্রথম শুরু করেন তাঁেতর তৈরী বস্ত্রগুলো। মাফলার,ওড়না, শাড়ি, গামছা, উত্তরীয়, ত্রিপিচ সহ বিভিন্ন জিনিস তিনি তৈরি করতেন। বাড়িতে এস কিছু পাইকাররা এস নিয়ে থাকেন এগুলো। তাছাড়া জেলার বিভিন্ন তাঁতবস্ত্র দোকানের চাহিদা আসলেই তিনি সে হিসেবে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরি করে দিয়ে থাকেন।

অবিবাহিতা রাধাবতী দেবী থাকেন ছোট ভাইয়ের সাথে বাবার বাড়ি। ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত মাধমিক শিক্ষক রঞ্জীত সিংহের পরিবারে তিনি সহ ১০ সদস্য। তিনি তাঁতবস্ত্র তৈরি করে সংসার চালাতে ভাইকে সহায়তা করেন। তিনি আদমপুরে তেতইগাও রসিদ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে মাত্র ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন রাধাবতী দেবী।

বাড়িতে টকটকি (তাঁতের কাঁঠের মেশিন) দিয়ে মণিপুরি বস্ত্র বুনন করেন। তাঁতবস্ত্র তৈরিতে ১৯৮৬ সালে প্রথম ভারতের মণিপুরের ইম্পলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এরপর কমলগঞ্জের মাধবপুরে মণিপুরি ললিত কলা একাডেমিতে ২০১০ সালে ২ বার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেই থেকে তিনি এখন মণিপুরি তাঁতবস্ত্র বুননে এলাকায় একজন ওস্তাদ (গুরু) হয়ে গেছেন। সেই সূত্র ধরে বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরিজি কয়েক মাস আগে খোঁজ করে তাকে নিয়ে যান বান্দরবনে। তাকে দেখানো হয় কলাগাছের আশের সুতায় তৈরি ব্যাগ, জুতা, পাপোস, ফুলদানি, ফাইল কভার, কলমদানিসহ হস্তশিল্প সামগ্রী। বলা হয় কলাগাছের সুতা দিয়ে একটি শাড়ি বুনন করে দিতে।

প্রথমে সামান্য চিন্তায় পড়ে গেলেও এ সতোয় অন্যান্য হস্তশিল্প বুনন সম্ভব হলে শাড়ি কেনো সম্ভব নয়। এ প্রশ্ন নিজের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করায় মনের জোরে ও সাহসে তিনি রাজি হয়ে কলাগাছের কিছু সুতা সাথে এনে কমলগঞ্জে নিজ বাড়িতে তাঁত সুতার সাথে মিশিয়ে প্রথমে একটি ওড়না বুনন করলেন। এরপর নিজ বাড়ি থেকে তাঁতের সুতা সাথে নিয়ে বান্দরবন গিয়ে শুরু করেন শাড়ি বুনন। এক কেজি কলার সুতার সাথে তাঁত সুতার সংমিশ্রণ করে টানা ১৫ দিনে কলার সুতার শাড়ি বুনন করে চমকে দিলেন সবাইকে। বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরিজও এ উদ্যোগে সফল হলেন বলে মণিপুরী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী মনে করেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীতে আর কম সময়ে ও কম খরচে আরও মসৃণ ও উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে।

রাধাবতী দেবী আরও বলেন, সেখানে কলাগাছের আশের সুতার সরবরাহ প্রচুর বলে সেখানকার ত্রিপুরী তরুন তরুণীর প্রশিক্ষণ নিয়ে কলার সুতা দিয়ে ব্যাগ, জুতা, পাপোস, ফুলদানি, ফাইল কভার, কলমদানিসহ হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছে ও বিদেশে রপ্তানি করছে। বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক তাকে দিয়ে আরও কয়েকটি শাড়ি তৈরির চিন্তা করেছেন বলে তাকে জানিয়েছেন। এমনকি তাকে দিয়ে কলার সুতার শাড়ি তৈরির একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার মনোভাব তিনি প্রকাশ করেছেন বলে জানান।

মণিপুরী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী এক সময় সিলেট অবস্থান করায় সেখানে মীরা বাজার এলাকায় সমবায় অফিসের তাঁতবস্ত্র বুননের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন নিজ এলাকার অনেক মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে বস্ত্র বুনন উদ্যোক্তা বানিয়েছেন। যারা প্রশিক্ষন নিয়ে তারা আজ সফল হয়েছে বলে জানান রাধাবতী দেবী।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁতবস্ত্র মেলায় তিনি মণিপুরি তাঁতবস্ত্র উপস্থাপনও করেছিলেন। স¤প্রতি কলাগাছের সুতায় শাড়ি তৈরির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তিনি রোববার সকালে গ্রামে ফিরলে সরেজমিন বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা তার খোঁজ খবর নিয়ে এ সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছেন। এখন স্থানীয় ও দেশব্যাপী তার একটি পরিচিতি আলাদাভাবে বেড়েছে। তিনি দেশের গর্ব তাই দেশের জন্য আর কি করবেন জানতে চাইলে বলেন, সরকারি সহায়তায় কলাগাছের সুতায় শাড়ি বুনন শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে আছে। এতে এলাকার, দেশের ও সবার লাভ হবে বলে মনে করেন। রাধাবতী দেবী ঠিক স্পষ্ট বাংলায় কথা বলতে না পারলেও ছোট ভাই রঞ্জীত সিংহ কথা বুঝতে সহায়তা ও বড় বোনের আবেগের কথা জানান।

মণিপুরী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী এ প্রতিবেদক কে আরো বলেন,বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক শাড়ির তৈরীর পর প্রধান মন্ত্রীকে দিবে বলেছিলেন। কিন্তু আমি বলেছি প্রথম শাড়ি তেমন ভালো হবে না। আমি আমার মনের মতো করে শাড়ি বানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দিবো।

রাধাবতী দেবীর ছোট ভাই শিক্ষক রঞ্জীত সিংহ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বোন ছোট কাল থেকে তাতের উপড় বিভিন্ন প্রশিক্ষন নিয়ে ছিল। তার কাছ থেকে হাজার হাজার মেয়েরা কাজ শিখেছে। নিঃস্বর্থে মানুষদের কাজ শিখাতো। বোনের কাজগুলো আমার মা বাবা সবাই সাপোর্ট দিতো। আজ আমার বোন দেশের জন্য এমন একটা কাজ করলো সেটা আমাদের গর্ভের বিষয়। ১৫ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে কলাগাছের তন্তু থেকে প্রথমবারের মতো শাড়িটি তৈরি করতে সফল হয়ে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। এজন্য আমার বোন রাধাবতী দেবী মণিপুরি সমাজ ও কমলগঞ্জ,মৌলভীবাজার তথা সিলেট জেলাবাসী গর্বিত ও আনন্দিত। মণিপুরি সমাজের ঘরে ঘরে এখন আনন্দের বন্যা বইছে।’

এদিকে মৌলভীবাজারে নিজ গ্রামে সংবর্ধিত করা হল দেশে প্রথমবারের মতো কলাগাছের তন্তু থেকে সুতা তৈরি করে মণিপুরি শাড়ির উদ্ভাবক রাধাবতী দেবী। গত সোমবার (৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে ইন্দো বাংলা এবং ভানুবিল মাঝেরগাওঁ কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমের উদ্যোগে এই সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন,মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামের সন্তান মণিপুরি তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী চ্যালেঞ্জ নিয়ে ১৫ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে কলাগাছের তন্তু থেকে প্রথমবারের মতো শাড়িটি তৈরি করে সফল হয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। রাধাবতী দেবীর জন্য মণিপুরি সমাজ ও কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজার জেলাবাসী গর্বিত ও আনন্দিত। মণিপুরি সমাজের ঘরে ঘরে এখন আনন্দের বন্যা বইছে।

উল্লেখ্য-বান্দরবান জেলা প্রশাসকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জ উপজেলা থেকে বান্দরবানে ছুটে এসেছেন মণিপুরী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী। তার প্রচেষ্টায় ও কর্ম-কৌশলে পরীক্ষামূলক এ শাড়ি তৈরি করা হলো। শাড়ি তৈরি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।

জেলা প্রশাসক সূত্রে জানা যায়,বান্দরবানে নারীদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে কলাগাছ থেকে আঁশ তৈরি ও পরবর্তী সময় সেই আঁশ থেকে হস্তশিল্প ও শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরির জন্য জেলা প্রশাসন একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৪০০ নারীকে কয়েক দফায় প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ভাতা দেয়া হয়, যাতে তারা আগ্রহী হয়। প্রকল্পটি এখন উপজেলা পর্যায়েও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। স্বল্প সময়ে উন্নতমানের শাড়ি তৈরির জন্য জেলা প্রশাসন দুটি মেশিনের আবেদন পাঠাচ্ছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে। এ দুটি মেশিন পাওয়া গেলে বাণিজ্যিকভাবে এই শাড়ি তৈরি করে বাজারজাত করা যাবে। ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর বান্দরবানের কুহালং ইউনিয়নের আমতলী পাড়াতে কলাগাছের বাকল থেকে সুতা তৈরির উদ্ভাবনী প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।