‘আইন প্রভাবশালীদের দিকে একটু হেলে পড়ে’

প্রকাশিত: ৩:৪৩ অপরাহ্ণ, জুন ২৪, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক ; সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর মামলার প্রধান আসামি শহীদুল ইসলাম স্বাধীন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
তবে মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার তরুণ ঝুমন দাস আপন জামিন পাননি। তিনি এখনও কারাগারে। উচ্চ আদালতে তার জামিনের শুনানি হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

স্বাধীনের জামিনআর ঝুমনের কারাগারে থাকা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা দেখেছি, প্রভাবশালীদের দিকে আইন একটু হেলে পড়ে। সেটা অর্থশালী হোক আর ক্ষমতার দিক দিয়ে প্রভাবশালী হোক অথবা পেশি শক্তির অধিকারীই হোক। এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা এক সময় শেষ হয়ে যাবে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসনথাকাটা জরুরি। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে অপপ্রয়োগ হচ্ছে সেটা তো আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে এই আইনটির সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না।’

শুধু স্বাধীন নয়, দুর্নীতির মামলায় প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে জামিন পেয়েছেন যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান। গত ৯ মার্চ ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত ২০ হাজার টাকা মুচলেকায় তার জামিন মঞ্জুর করেন। যদিও বিষয়টি এতদিন জানা যায়নি। একইভাবে ঘুস গ্রহণ ও অর্থপাচার আইনের মামলায় বরখাস্তকৃত সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) পার্থ গোপাল বণিককেও জামিন দিয়েছেন আদালত।

একই ধরনের দুর্নীতির মামলায় কারও জামিন হচ্ছে, আবার কারও হচ্ছে না? এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘ঢালাওভাবে তো এগুলো নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। প্রতিটি মামলাই আলাদা। কোন মামলায় কী আছে সেটা দেখে বলতে হবে। হুট করেই এগুলো নিয়ে মন্তব্য করাও ঠিক হবে না।’

তবে সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘একই ধারার মামলায় আদালত একজনকে জামিন দিতে পারেন, আরেকজনকে জামিন নাও দিতে পারেন। এটা আদালতের এখতিয়ার। আদালত যেটা দেখেন একই ধারার দুর্নীতির মামলা হলেও কার দুর্নীতির পরিমাণ কত? একজন হয়ত অবৈধভাবে তিন লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। অন্যজন একশ’ কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। দু’টি মামলার ধারা কিন্তু এক। কিন্তু আদালত তিন লাখ টাকা দুর্নীতি করা ওই লোকটিকে আগে জামিন দেন। এই কারণে দেখবেন দুর্নীতির মামলার শুরুতেই আদালত শোনেন কত টাকার দুর্নীতি করেছেন।’

গত ১৭ মার্চ হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয় নোয়াগাঁও গ্রামের ৮৮টি হিন্দু বাড়িতে। এ সময় পাঁচটি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। ঝুমন দাস আপনের ফেসবুক আইডি থেকে মামুনুল হককে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে এই হামলা চালানো হয়। যদিও হামলার ঘটনার আগেই পরিবারের লোকজন ঝুমনকে থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল ৫০ জনের নাম উল্লেখ করে দেড় হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। শাল্লা থানা পুলিশও একটি মামলা করে। এ ছাড়া ঝুমন দাসের মা নিভা রানী দাসও আরেকটি মামলা করেন। এই মামলায়ও ৭০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। সব মামলায় প্রধান আসামি স্বাধীন।

সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নোয়াগাঁওয়ের ঘটনায় বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল এবং পুলিশের করা দুটো মামলাই দুর্বল। এরই সুযোগ নিয়েছে আসামিপক্ষ। প্রথমে পুলিশ যে মামলা করেছে সেটা তো চুরির মামলা। পরে আমরা এটা নিয়ে কথা বলার পর কিছু ধারা নতুন করে যুক্ত হয়েছে। আমরা বলেছি, এটা ধর্মীয় উসকানির বিষয় বলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের যাওয়ার মতো মামলা। নতুন কিছু ধারা যোগ করলে তো আর মামলা শক্তিশালী হয় না। ফলে সহজেই জামিন পেয়েছে স্বাধীন। অন্যদিকে ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। সাধারণত নিম্ন আদালত এই মামলায় জামিন দিতে চান না।’

শাল্লার হিন্দু গ্রামে হামলার ঘটনায় পুলিশ সব মিলিয়ে ১০৫ জনকে গ্রেফতার করে। এদের বেশিরভাগ আসামি ইতোমধ্যে জামিন পেয়েছে। ১৮ জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। সুনামগঞ্জ ডিবির ওসি ইকবাল বাহার জানান, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া ১৮ জনই ভাঙচুর-লুটপাটে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। শহীদুল ইসলাম স্বাধীনও যে হামলায় ছিলেন- ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার সময় অনেকেই তা বলেছে। তবে স্বাধীন নিজে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটির এখনও তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি।

ঝুমনের ভাই নুপুর চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমরা ঝুমনের জামিনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একবার, জজ কোর্টে একবার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আদালত জামিন দেননি। সর্বশেষ গত সোমবার হাইকোর্টে জামিনের জন্য তোলা হয়েছিল। কিন্তু আদালত শোনেননি। পরে শুনবেন বলে ফেরত দিয়েছেন। পুলিশ ঝুমনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কী পেয়েছে সেটাও আমাদের বলে না। আবার জামিন চাইলে বিরোধিতা করে। এর মধ্যে স্বাধীনের জামিন হয়ে গেল। গতকালই সে এলাকায় এসেছে। এলাকায় গুজব রয়েছে, তার লোকজন অনেকদিন ধরেই বলছিলেন, স্বাধীন আসুক তারপর…। এখন কী হবে সেটাই বুঝতে পারছি না। আবার আমার ভাইয়ের ফেসবুক এখনও খোলা। পুলিশ তার কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়েছে। কী যে হচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় গেলে বিচার পাব তাও জানি না।’

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমরা দেখেছি নিম্ন আদালত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জামিন দিতে চান না। দিচ্ছেনও না। অথচ হামলা, ভাঙচুরের মতো ফৌজদারি অপরাধের মামলায় জামিন দিচ্ছেন। এটা উচিত না।’

প্রসঙ্গত, সাবেক যুবলীগ নেতা কাজী আনিসুরের বিরুদ্ধে ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলা করেন কমিশনের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। ওইদিন কাজী আনিছের স্ত্রী সুমি রহমানের বিরুদ্ধে এক কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জনের অভিযোগেও আরেকটি মামলা হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলার চার্জশিট দাখিল করেন একই কর্মকর্তা। এর আগে সুমি রহমানও জামিন পেয়েছেন। একইভাবে ডিআইজি প্রিজন্স পার্থ গোপাল বণিক দুর্নীতি ও ঘুসের মাধ্যমে ৮০ লাখ টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেন। ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডির ভূতের গলিতে পার্থ গোপাল বণিকের নিজ ফ্ল্যাট থেকে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়। সূত্র: ডয়েচে ভেলে।