খাগড়াছড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্মৃতি ভাস্কর্য ‘চেতনা’

প্রকাশিত: ১২:০১ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৭, ২০২০

অনলাইন ডেস্ক : মহান মুক্তিযুদ্বের শহীদদের স্মরণে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৗধ। ১৯৭১ সালের সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাক হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। আর সে মুহূর্তে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের স্থানীয়দের সংগঠিত করে পাকবাহিনীর বিরুদ্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্মুখযুদ্ধে এবং শাহাদাত বরণ করেন।

তারই সম্মানে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের কলেজগেট এলাকার মাইনি বেইলী নামক স্থানে স্মৃতিসৌধ ও খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি মহাসড়কে মহালছড়ি উপজেলার প্রবেশমুখে কলেজের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। এছাড়া পৌর শহরের টাউন হল চত্বরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ স্মৃতি ভাস্কর্য ‘চেতনা’ ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সংবলিত জাতীয় পতাকা ও অস্ত্র হাতে একটি ভাস্কর্য সদর উপজেলা পরিষদের সামনে নতুন করে নির্মাণ কাজ চলছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের, মাটিরাঙ্গা আদর্শ উপজেলা পরিষদের সামনে স্মৃতিস্তম্ভ র্দুজয়, গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়া এলাকায় খাগড়াছড়ি – চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার রাস্তার প্রবেশমুখে স্মৃতিস্তম্ভ, মানিকছড়ি উপজেলায় মানিকছড়ি চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে উপজেলা পরিষদের কাছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, সাবেক মহকুমা শহর রামগড় উপজেলা পরিষদে যাওয়ার প্রবেশমুখে লেকের পাড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ, পানছড়ি উপজেলার জিরোমাইর নামক স্থানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দীঘিনালা ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে।’

এদিকে পৌর শহরের আদালত সড়কের টাউন হল চত্বরে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভটিতে তিনজন মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি রয়েছে। একজনের হাতে রয়েছে অস্ত্র, আরেকজন হাত দিয়ে অস্ত্র ধরে ওপরে তুলে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, আরেক জনের হাতে রয়েছে জাতীয় পতাকা; যার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা, বিজয় এবং রক্ষার অঙ্গীকার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একই চত্বরে ২০১১ সালের প্রায় শেষের দিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ স্মৃতি ভাস্কর্য ‘চেতনা’ নির্মাণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে

খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলমের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ স্মৃতি ভাস্কর্য ‘চেতেনা’ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ আফতাবুল কাদেরের ভাস্কর্য : ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি মহাসড়কে মহালছড়ি উপজেলার চব্বিশ মাইল নামক এলাকায় আহত হলে রামগড় নেওয়ার পথে শাহাদাত বরণ করেন। যে স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সে স্থানে তার প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ফেনীর শুভপুর ইপিআর বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শুভপুর ব্রিজ এলাকায় তখন পাকবাহিনী হেলিকপ্টারের সাহায্যে ছত্রীসেনা নামাচ্ছিল। পাক ছত্রীসেনাদের একজনকে ক্যাপ্টেন আফতাব কয়েকজন গ্রামবাসীর সহায়তায় ধরে ফেলেন এবং ২ এপ্রিল ওই পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে আফতাবুল কাদের রামগড়ে পৌঁছান, ৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয় ক্যাপ্টেন আফতাবের ব্যস্ত জীবন। ইপিআর বাহিনীর হাবিলদার কালামের প্লাটুন নিয়ে স্থাপন করেন জোরালগঞ্জের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। নেতৃত্ব দেন ধুমঘাটের ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার অপারেশনে। উড়িয়ে দেন ধুমঘাটের রেলওয়ে ব্রিজটি। রামগড় ফিরে এসে ক্যাপ্টেন দেখলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার কয়েকশ ছাত্র-যুবক সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন, ক্যাপ্টেন আফতাব পাঁচশত তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য রামগড় হাইস্কুল মাঠে স্থাপন করেন একটি ট্রেনিং সেন্টার।

২১ এপ্রিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন আফতাব যুদ্ধে তার একজন সহকর্মী আহত হন। ২৪ এপ্রিল বুড়ির ঘাটে শত্রæদের সঙ্গে চলছিল ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে শত্রুপক্ষ পিছু হটার পর ক্যাপ্টেন আফতাব নিজ বাহিনীর সদস্যদেরকে একত্রিত করে মহালছড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। ২৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য (১৩৬ জন) এবং একটি মিজো ব্যাটালিয়নকে (১০০০ জন) সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ চালায় মহালছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। চরম এ বিপজ্জনক অবস্থায় সহযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণের পরামর্শ দেন ক্যাপ্টেন আফতাবকে। কিন্তু অকুতোভয় তেজোদীপ্ত বীর সেনানি সহযোদ্ধা ছাত্তার, ফারুক, শওকত এবং ইপিআরের দুই সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে তিনটি এলএমজির অবিরাম গুলিবৃষ্টি কোণঠাসা করে ফেলে শত্রুদের।

চরম এই মুহূর্তে হঠাৎ এক সহযোদ্ধার এলএমজির ফায়ারিং বন্ধ হয়ে যায়, শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার জীবন শত্রæর হাত থেকে বাঁচাতে তিনটি এলএমজির একটি অচল হয়ে পড়ায় অস্থির হয়ে পড়েন ক্যাপ্টেন আফতাব। মেরামতের জন্য অস্ত্রটি তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশের পরও সহযোদ্ধার আসতে দেরি হওয়ায় যুদ্ধরত আফতাব নিজেই ক্রলিং করে এগিয়ে যেতেই শত্রুর অস্ত্রের কয়েকটি গুলি এসে বিঁধে তার গায়ের বিভিন্ন অংশে। আহত আফতাবকে জিপ গাড়িতে করে চিকিৎসার জন্য রামগড় নেওয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করেন, সহযোদ্ধা ফারুক, শওকত, ড্রাইভার আব্বাস বীর শহীদের মরদেহ রামগড় নিয়ে আসেন। রামগড়েই তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু শহীদ আফতাব যেখানে শত্রুর গুলিতে আহত হন সেই মহালছড়িতেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তার ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর বীর-উত্তম উপাধিতে ভূষিত করেন।