কৃষি ও কৃষকের জন্য কৃষি সাংবাদিকতা যে কারণে জরুরি

প্রকাশিত: ১২:০২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০২০

নিউজ ডেস্ক :ইফ ইউ এট টুডে, থ্যাঙ্ক এ ফার্মার অর্থ্যাৎ আপনি যদি আজ উদরপূর্তি করে থাকেন তাহলে কৃষককে ধন্যবাদ জানান, প্রবাদটি ইউরোপে বহুল প্রচলিত। প্রত্যেক সমাজে কৃষকদের আলাদা সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমাদের সমাজব্যাবস্থা সম্পর্কে আমরা অবহিত। কৃষকরা শুধু কৃষিকে নয় আমাদেরও বাঁচিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশ এখনও কৃষিভিত্তিক। দেশটির বৃহৎ অংশের জীবন জীবিকার উৎস কৃষি। পৃথিবীর ১০০০(এক হাজার) ভাগের এক ভাগ পরিমাণ আমাদের ভূমি। অন্যদিকে জনসংখ্যা আছে এক হাজার ভাগের ২৪ জন। আমরা দেশ ঘনবসতিপূর্ণ। তাছাড়া কিছু তথ্য সবারই জানা। প্রতিবছর এক শতাংশ হারে আবাদি জমি হারাচ্ছি।

আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো কৃষি যোগাযোগে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে ভারতের কেরালা রাজ্যে রাষ্ট্র তথ্য প্রযুক্তি মিশন টুলমুক্ত কৃষি বাণিজ্যিকভিত্তিক কল সেন্টার এবং ওয়েবসাইট চালু করে। ফলে কেরালার কৃষক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি হয়েছে বিপুল উৎসাহ,উদ্দীপনা ও একতা। নেপালি ই-হাটবাজার হল ই-কৃষির একটি নিদর্শন। যেখানে কৃষি পণ্যের সঠিক দাম ভিডিও ফুটেজ দেখতে পারছে নেপালি কৃষকরা। এই উদ্যোগ নেপালি কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জনবহুল ও কৃষি উন্নত দেশ গণচীনে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত একাধিক কৃষিভিত্তিক টেলিভিশন স্টেশন রয়েছে।যেগুলোতে প্রতিদিনের সর্বশেষ কৃষিতথ্য ও চিত্র প্রচার করা হয়।ফিলিপাইনের কৃষি সচিব প্রতিদিন সকালে উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড ধান আবাদ বিষয়ে কৃষকদের উদ্দেশ্যে জনসচেতনতামূলক বক্তব্য দেন। তাছড়া পৃথিবীর সব দেশই কৃষি পণ্যের প্রতিদিনের বাজারদর সংক্রান্ত আপডেট তথ্য প্রচার করে থাকে।

অন্যদিকে, চীন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিল কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। তখন প্রতি আটজন নাগরিকের একজন কৃষি কাজের সাথে যুক্ত ছিল। আটাত্তরের পরবর্তীতে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি দ্রুতই পাল্টাঠে থাকে। অর্থনীতির উন্নতির শিঁখরে পৌছাতে চীনকে মূল জ্বালানি যুগিয়েছে কৃষি।

কৃষিজমি আমাদের অফুরান বেঁচে থাকার উৎস। যে দুটি প্রকৃতির আর্শিবাদকে জীবন ও জীবিকার উপাদান হিসেবে দেখা হয়। একটি মাটি অন্যটি পানি। পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এ সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেচ বিভাগের একটি গবেষণা রয়েছে ১৯৭৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। গবেষণাটি গাজীপুরের পানির স্তর সম্পর্কিত। ১৯৭৯ সালে ৮ মিটার নিচে পানির স্তর পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৩ সালে পানি স্তর নামতে নামতে ৩২ মিটারে ঠেকেছে। ১৯৯৭ সালেও পানির স্তর ১২ মিটার ছিল। ১৯৯৭ পরবর্তী প্রতি বছর পানির স্তর প্রায় ২ মিটার করে নেমে যাচ্ছে।

অন্যসব জায়গায় নেমে যাওয়া পানির স্তর বর্ষা মৌসুমের পর পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু গাজীপুরের পানির স্তর বর্ষা মৌসুমের পরও পূর্বাবস্থায় ফিরছে না। এভাবে নামতে থাকলে সামনে নিশ্চয় সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। একসময় আমরা টিউবওয়েলে পানি পাব না। ভারতসহ উন্নত বিশ্বে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ রয়েছে। আমরা একটু সচেতন হলে বাড়ির ছাদ থেকে একটি পাইপ মাটির নিচে অ্যাকুফেয়ারে ঢুকিয়ে দিলে ভূ-গর্ভস্ত পানির স্তরের উন্নয়ন হয়। তাছাড়া প্রত্যেক এলাকায় একটি বিশাল উন্নুক্ত জলাধার নির্মাণ করে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নয়ন ঘটানো যায়।

বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ রয়েছে পেটে গেলে পিঠে সয়। বরিশাল অঞ্চলের মানুষজন মোটা চালের ভাত পছন্দ করে। তাদের যুক্তি মোটা চালের ভাত পেটে বেশি সময় ধরে থাকে। ব্যাপারটির সাথে কোন ধরনের বিজ্ঞানের যুগসূত্র আছে কিনা। নাকি শুধুই প্রবাদ। কিংবা সামাজিক অর্থনৈতিক কারণইবা কী?

বহুমাত্রিক ফসল ধান। পানিতেও বাঁচতে পারে, মরুভূমিতেও জন্মায়। ১৬ ফুট পানির নিচ থেকেও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ধান গাছ খরায়ও বেঁচে থাকতে পারে। পাহাড়ে ধান ফলানো যায় আবার হাওড়ের নিচু ভূমিতেও ধানের ফলন পাওয়া যায়। গাছটির উচ্চতায়ও রযেছে রকমফের।সেইসাথে ফলনেও। শীতপ্রধান দেশ থেকে গরম প্রধান দেশেও ফলন দেয়। কৃষি বিজ্ঞানের বিচিত্র মজার ব্যাপারগুলো লেখালেখিতে উঠে আসতে পারে। এতে করে কিশোর কিশোরীদের মাঝে বিজ্ঞানের আলাদা জায়গা তৈরি হবে।

কৃষির কিছু বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। যেমন পেস্টিসাইড জমিতে প্রয়োগের সময় মাস্ক, গগজ ও এপ্রনের ব্যাবহার।পেস্টিসাইড বলতে আগাছানাশক,কীটনাশক ও জীবানুনাশককে বুঝানো হয়। সঠিক মাত্রা ও সঠিক পরিমাণ প্রয়োগের বিষয়ে কৃষকের সচেতনতা জরুরি। সেইসাথে কেমন কৃষি বাজেট চাই? কৃষি বাজেট ও কৃষি ঋণ সমন্ধে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

বর্তমানে আমরা একটা পরিবর্তনশীল সমাজে বসবাস করছি। পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত।কৃষি পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন আসছে। কিছু নতুন নতুন ফসলের আবাদ বাড়ছে। যেমন ভুট্টা, সূর্যমুখি ইত্যাদি। কিছু ফসলের আবাদ কমছে।

তেমনি একটি ফসল পাট। অন্যদিকে কৃষকরা লাভজনক শস্যবিন্যাস ও ফসলের দিকে ঝুঁকছে। যেমন আদা, হলুদ,ফুলসহ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ফসলের আবাদ বাড়ছে হু হু অভিযোজনের একটা অভিজ্ঞতা বর্ণনা তুলে আনতে পারি। গত ৮ মে,২০১৪ লবণাক্ত এলাকা খুলনার রূপসা থানার অন্তর্গত চরনন্দনপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। খুলনা শহরের বাইরে একটি দ্বীপ বলা চলে। এই ছোট্ট চরটির চারদিকে ভৈরব, রূপসা সহ আরো নদী। সবগুলো নদীর পানিই লবণাক্ত। বছরের এ সময়টায় লবনাক্ততা সমস্যা প্রকট আকার ধারন করে। গ্রামটিতে মিঠা পানির একমাত্র অবলম্বন বৃষ্টিনির্ভরতা।

এখানে ধান চাষ অসম্ভব একটা ব্যাপার। গ্রামের কৃষকরা বিশাল একটি জমির চারপাশ ১০ হাত প্রস্থে ও ১৫-২০ হাত গভীরতার পুকুর তৈরি করেছে শুধুমাত্র যাওয়া আসার জন্য একটি কোন ছেড়ে দিয়ে। পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। পুকুরের পানি দিয়ে মাঝখানের জমিতে চাষাবাদ হয় ধান। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন অভিযোজনের ব্যাপারগুলো কৃষকরাই আবিষ্কার করছে।

জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদ নদীগুলো ফিবছর আমাদের ভূমিকে বিনাখরচায় উর্বরতা নবায়ন করে যাচ্ছে। আমাদের কৃষির সমস্যা, সম্ভাবনা উপলদ্ধি করতে দরকার কৃষকের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো। দেশ ও বিভূইয়ের কৃষি উদ্যোগগুলো আমাদের কলমের আঁচরে উঠে আসা উচিত। পরিবেশ, জলবায়ু, কৃষি ও কৃষক নিয়ে লিখালিখিতে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মাধ্যমে আমি সোচ্চার রয়েছি। আরো অনেককেই কৃষির বৃহত্তর স্বার্থে কলম হাতে তুলে নিতে হবে। কৃষি বিষয়ক লেখালেখির জন্য হাওলাদার প্রকাশনীর এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করেছে। উপরের নিবন্ধটি বইটির আংশিক সংক্ষেপিত।

লেখক: র্ঊধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট,আঞ্চলকি র্কাযালয়, বরশিাল।
mkabir1986@gmail.com